বিশেষ প্রতিবেদকঃ জুলাই–আগস্টের ছাত্র–জনতার রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পর দেশের মানুষ ভেবেছিল, রাষ্ট্রীয় দপ্তরগুলো থেকে ফ্যাসিবাদী প্রভাব ও দুর্নীতিবাজ চক্র বিদায় নেবে। কিন্তু বাস্তবতা যেন ঠিক উল্টো। গণপূর্ত অধিদপ্তর (PWD) এখনো পুরোনো ক্ষমতার বলয়ের মধ্যেই আটকে আছে। অভিযোগ উঠেছে, নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের সাবেক নেতা হারুন অর রশিদ কৌশলে নিজেকে ‘বৈষম্যের শিকার’ দাবি করে নারায়ণগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব বাগিয়ে নেন এবং মাত্র ১১ মাসেই প্রায় ১০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা লুটপাট করেন।
হারুন অর রশিদ কোনো সাধারণ কর্মকর্তা নন। তিনি বুয়েট ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সভাপতি এবং ক্যাম্পাসে থাকাকালীন সময়েই তার বিরুদ্ধে সিট বাণিজ্য, টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ভয়ভীতি ও দমন–পীড়নের একাধিক অভিযোগ ছিল। সরকারি চাকরিতে ঢোকার পর সেই একই ক্যাডার সংস্কৃতি তিনি গণপূর্ত অধিদপ্তরে চালু করেন। অফিসের ভেতরেও তিনি প্রভাব, ভয় এবং অবৈধ লেনদেনের মাধ্যমে নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করেন বলে অভিযোগ।
৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর হারুন হঠাৎ করেই নিজেকে নিপীড়িত কর্মকর্তা হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করেন। তবে তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থাকা পুরোনো ছবি ও পোস্টে আওয়ামী লীগের মিছিল, ছাত্রলীগ নেতাদের সংবর্ধনা গ্রহণ এবং দলীয় কর্মসূচিতে সক্রিয় উপস্থিতির স্পষ্ট প্রমাণ দেখা যায়। এসব তথ্য তার রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে প্রশ্ন আরও জোরালো করে।
গণপূর্তে হারুনের উত্থানের পেছনে বড় ভূমিকা রয়েছে আলোচিত কর্মকর্তা আতিকুল ইসলামের। আতিকুল ইসলাম বর্তমানে ওএসডি হলেও দপ্তরের ভেতরে তাকে এখনো ‘পাওয়ার হাউস’ হিসেবে দেখা হয়। অভিযোগ অনুযায়ী, হারুন ছিলেন আতিক সিন্ডিকেটের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ব্যক্তি এবং কার্যত দপ্তরের ভেতরের অর্থ সংগ্রহের দায়িত্ব তার হাতেই ছিল।
সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে আতিকুল ইসলামের স্ত্রীর মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাডরয়েড কনসাল্ট্যান্টস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারস’কে কেন্দ্র করে। হারুন টেন্ডার প্রক্রিয়াকে এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন, যাতে এই একটি প্রতিষ্ঠানই বারবার সরকারি কাজ পায়। কাগজে-কলমে প্রতিযোগিতা দেখানো হলেও বাস্তবে অন্য ঠিকাদারদের অংশ নেওয়ার সুযোগই দেওয়া হতো না।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, অক্টোবর ২০২৪ থেকে পরবর্তী ১১ মাসে হারুনের তত্ত্বাবধানে মোট ২১টি কাজ অনুমোদন দেওয়া হয়, যার মোট মূল্য প্রায় ১০ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ঘটনা ঘটে ১০ মার্চ ২০২৫ তারিখে। ওই একদিনেই ছয়টি বড় প্রকল্পের টেন্ডার আহ্বান করা হয় এবং আশ্চর্যজনকভাবে ছয়টির ছয়টিই পায় ‘অ্যাডরয়েড কনসাল্ট্যান্টস অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারস’। অভিযোগ রয়েছে, একক দরদাতা দেখিয়ে পুরো প্রক্রিয়াটি সাজানো নাটক ছিল।
নারায়ণগঞ্জে আসার আগেও হারুনের বিরুদ্ধে গুরুতর অনিয়মের অভিযোগ ছিল। রাজশাহী গণপূর্তে দায়িত্ব পালনকালে তিনি টেন্ডার ছাড়াই সরকারি ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করেন বলে অভিযোগ ওঠে। সে সময় এসব অভিযোগ চাপা পড়ে যায়, কারণ তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী শামীম আখতারের সরাসরি আশ্রয় তিনি পেয়েছিলেন।
শামীম আখতারের ভূমিকা নিয়েও এখন গুরুতর প্রশ্ন উঠছে। অভিযোগ রয়েছে, নিজের দুর্নীতির নেটওয়ার্ক টিকিয়ে রাখতে তিনি ছাত্রলীগ ঘরানার প্রভাবশালী কর্মকর্তাদের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে যান। হারুন অর রশিদ এবং আহসান হাবিবকে সেই পরিকল্পিত পুনর্বাসনের উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর যেখানে নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তাদের অপসারণ হওয়ার কথা ছিল, সেখানে ‘দক্ষতা’ ও ‘অভিজ্ঞতা’র অজুহাতে তাদের বহাল রাখা হয়েছে। এতে করে আন্দোলনে রক্ত দেওয়া শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা গণপূর্ত অধিদপ্তরে উপহাসে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বঞ্চিত ঠিকাদার ও দুর্নীতি বিশ্লেষকদের মতে, হারুন অর রশিদের বিরুদ্ধে এখনই কঠোর ব্যবস্থা না নিলে গণপূর্তে শৃঙ্খলা ফিরবে না। তারা বলছেন, তার সম্পদের উৎস, ব্যাংক লেনদেন এবং টেন্ডার প্রক্রিয়ায় ভূমিকা খতিয়ে দেখে ফৌজদারি মামলার আওতায় আনা জরুরি। একই সঙ্গে আতিক সিন্ডিকেটের সব প্রতিষ্ঠানকে ভবিষ্যতে সরকারি কাজ থেকে নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে।
নারায়ণগঞ্জের সাধারণ ঠিকাদারদের প্রশ্ন আরও তীক্ষ্ণ—হারুনের মতো নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতা যদি এখনো টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করেন, তাহলে জুলাই মাসে ছাত্ররা কেন জীবন দিল? আতিকুল ইসলাম ওএসডি হলে তার ঘনিষ্ঠ সহযোগী হারুন কীভাবে এখনো ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকেন? এসব প্রশ্নের উত্তর এখনো অধরা।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের ভেতরেও অসন্তোষ বাড়ছে। অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীর ভাষায়, এখানে শুধু ‘পুরোনো মদের নতুন বোতল’ দেখা যাচ্ছে। এখন দেখার বিষয়, অন্তর্বর্তী সরকারের উচ্চপর্যায় এই দুর্নীতির বলয় ভাঙতে সত্যিই সাহসী পদক্ষেপ নেয় কিনা, নাকি এই সিন্ডিকেট আগের মতোই টিকে থাকে।