বিশেষ প্রতিবেদকঃ রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগ–১ এখন আর সাধারণ একটি সরকারি দপ্তরের মতো নেই—এমন অভিযোগ উঠেছে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করা একাধিক ঠিকাদারের কাছ থেকে। তাঁদের দাবি, এই দপ্তরটি ধীরে ধীরে পরিণত হয়েছে নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলামের আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠ মহলের জন্য “নিশ্চিত কাজ পাওয়ার জায়গায়”। কাগজে-কলমে দরপত্র ডাকা হলেও বাস্তবে কে কাজ পাবে, তা নাকি ঠিক হয়ে যাচ্ছে আগেই।
চলতি অর্থবছরে রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগ–১ বিভিন্ন সরকারি ভবনের জরুরি সংস্কার ও মেরামত কাজে প্রায় ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েছে। কিন্তু অভিযোগ রয়েছে, এই অর্থের বড় অংশ প্রকৃত প্রতিযোগিতা ছাড়াই নির্দিষ্ট কয়েকজন ঠিকাদারের মধ্যে ভাগ হয়ে গেছে। ইজিপি (e-GP) পদ্ধতিতে বহু ঠিকাদার অংশ নিলেও ফলাফল আগেই নির্ধারিত থাকায় তাঁরা কাজ পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেছেন।
নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলামের দীর্ঘদিনের রাজশাহীতে অবস্থান এবং ব্যক্তিগত যোগাযোগই এই অনিয়মের মূল শক্তি হয়ে উঠেছে—এমন অভিযোগ উঠেছে সংশ্লিষ্ট মহলে। নোয়াখালীর বাসিন্দা হলেও তিনি শৈশব থেকেই রাজশাহীতে বেড়ে উঠেছেন, এখানেই পড়াশোনা করেছেন এবং রুয়েট থেকে স্নাতক শেষ করে গণপূর্ত বিভাগে যোগ দেন। প্রায় ১৬ বছর রাজশাহীতেই চাকরি করার সুবাদে তাঁর ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক এখন বেশ শক্তিশালী।
সবচেয়ে আলোচিত অভিযোগগুলোর একটি হলো আদালত ভবনের কাজ নিয়ে। রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল ভবনের প্রায় ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকার সংস্কারকাজ পেয়েছেন মো. রফিক নামের এক ঠিকাদার। অভিযোগ অনুযায়ী, তিনি নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলামের স্ত্রীর আপন চাচাতো ভাই। শুধু এই কাজ নয়, একই ঠিকাদার গণপূর্ত বিভাগের জোন কার্যালয়ের ছাদ সংস্কার ও টাইলস বসানোর আরও দুটি কাজ করছেন বলেও জানা গেছে।
এছাড়া, রাশেদুল ইসলামের আরেক নিকটাত্মীয় ফয়সাল কবির রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ভেতরের একটি সংস্কারকাজ পেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। বঞ্চিত ঠিকাদারদের প্রশ্ন—একই পরিবারের মানুষ বারবার কীভাবে সরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার কাজ পেয়ে যাচ্ছেন?
আরও বিস্ফোরক অভিযোগ এসেছে রাজশাহীর সার্কিট হাউস ও জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সংস্কারকাজ নিয়ে। ঠিকাদারদের দাবি, এই দুটি কাজের সিদ্ধান্ত টেন্ডার প্রকাশের আগেই নির্বাহী প্রকৌশলীর বন্ধু ইয়াসির আরাফাতের জন্য চূড়ান্ত করে রাখা হয়েছে। তাঁদের অভিযোগ, সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের অনেকেরই এমন কাজ করার পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা নেই, তবুও ব্যক্তিগত পরিচয়ের জোরে তারা একের পর এক প্রকল্প পেয়ে যাচ্ছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ঠিকাদার ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, নতুন নির্বাহী প্রকৌশলী দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অভিজ্ঞ ও নিয়ম মেনে কাজ করা ঠিকাদাররা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। তাঁর ভাষায়, “যোগ্যরা বসে থাকে, আর পরিচয় থাকলেই কাজ পাওয়া যায়।”
অভিযোগের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুল ইসলাম সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি দাবি করেন, ইজিপি পদ্ধতিতেই কাজ হয় এবং যোগ্যতার ভিত্তিতেই ঠিকাদাররা নির্বাচিত হন। তবে গণমাধ্যমের প্রশ্নের জবাবে তাঁর বক্তব্য ছিল আরও বিতর্কিত। তিনি বলেন, “আপনারা নিউজ করেন, আমার কিছু হবে না।” এই বক্তব্যে বঞ্চিত ঠিকাদারদের সন্দেহ আরও গভীর হয়েছে।
অন্যদিকে, তাঁর আত্মীয় ঠিকাদার মো. রফিক বলেন, জরুরি মেরামত কাজে অনেক সময় আগে কাজ শুরু হয়, পরে টেন্ডার হয়। কিন্তু অনেকের মতে, এই বক্তব্য সরাসরি সরকারি দরপত্র আইন ও স্বচ্ছতার নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
বিষয়টি নিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলছে, আত্মীয় হলেও কেউ টেন্ডারে অংশ নিতে পারেন, এতে আইনগত বাধা নেই। তবে যদি গোপন দরপত্র ফাঁস, আগাম কাজ ভাগ বা ক্ষমতার অপব্যবহার হয়ে থাকে, তাহলে তা তদন্তের আওতায় আনা হবে।
এদিকে বঞ্চিত ঠিকাদাররা দ্রুত নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন। তাঁদের আশঙ্কা, এই পরিস্থিতি চলতে থাকলে রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগ–১ পুরোপুরি একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে এবং ইজিপি ব্যবস্থা কেবল নামমাত্র নিয়মে পরিণত হবে।