তদন্ত হয়নি মানেই কি নির্দোষ? হারুন অর রশিদ বিতর্কের নেপথ্য প্রশ্ন
হারুন অর রশিদের পক্ষে প্রকাশিত তথাকথিত “প্রতিবাদী প্রতিবেদন”-এ বারবার একটি কথাই ঘুরে ফিরে এসেছে—তার বিরুদ্ধে কোনো সরকারি নথিভুক্ত অভিযোগ নেই, কোনো তদন্ত হয়নি এবং সব টেন্ডার নাকি পিপিআর অনুযায়ী হয়েছে। কিন্তু অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার দৃষ্টিতে প্রশ্ন একটাই—অভিযোগ উঠলেই কি আগে মামলা থাকতে হবে? তদন্ত শুরু না হলে কি অনিয়মের অভিযোগ তোলা যাবে না? বাস্তবতা হলো, এই ধরনের ভাষ্য অভিযোগের জবাব নয়; বরং আইনি শব্দচয়ন দিয়ে সময় কেনার কৌশল মাত্র। অভিযুক্তের বক্তব্যই যদি পুরো সংবাদ হয়, তাহলে সেটি সংবাদ নয়—আইনি নোটিশের ভাষান্তর।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে তথ্যটি ওই প্রতিবাদী প্রতিবেদনে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে, সেটিই এখন আলোচনার কেন্দ্রে। ১০ মার্চ ২০২৫—একই দিনে নারায়ণগঞ্জ গণপূর্ত বিভাগের ছয়টি বড় প্রকল্পের টেন্ডার অনুষ্ঠিত হয়। আশ্চর্যজনকভাবে, ছয়টির ছয়টিই পায় একটি প্রতিষ্ঠান—‘অ্যাডরয়েড কনসাল্ট্যান্টস’। এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানা সংশ্লিষ্ট আতিকুল ইসলামের স্ত্রীর সঙ্গে—এ তথ্য অস্বীকার করার সুযোগ নেই।
এখানেই উঠে আসে গুরুতর প্রশ্ন। e-GP পদ্ধতি চালু থাকলেই কি সিন্ডিকেট অসম্ভব হয়ে যায়? একই পরিবার বারবার ‘সর্বনিম্ন দরদাতা’ হওয়াই কি স্বচ্ছতার একমাত্র প্রমাণ? তাহলে অন্যান্য ঠিকাদাররা কোথায় গেলেন? প্রতিযোগিতা কি কেবল কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ ছিল? এই প্রশ্নগুলোর একটিরও জবাব নেই তথাকথিত গৃহপালিত প্রতিবেদনে।
রাজনৈতিক পরিচয় প্রসঙ্গে হারুন অর রশিদের পক্ষে দাবি করা হয়েছে—তার বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো কিছু ছবি ও পোস্ট নাকি “AI দিয়ে তৈরি”। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। আওয়ামী লীগের বিজয় মিছিলে সরাসরি উপস্থিতি, ছাত্রলীগ নেতাদের ফুলেল সংবর্ধনা গ্রহণ এবং দলীয় কর্মসূচিতে প্রকাশ্য অংশগ্রহণ—এসব কি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে বানানো? নাকি নিষিদ্ধ রাজনৈতিক অতীত মুছে ফেলতেই এখন AI-কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে? ফেসবুক পোস্ট কেবল ছবি নয়; সেগুলো রাজনৈতিক অবস্থান ও সংশ্লিষ্টতার দলিল।
এই পুরো প্রক্রিয়ায় আরেকটি বিষয় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে—একাংশ গণমাধ্যমের ভূমিকা। প্রতিবাদী প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সেখানে নেই কোনো স্বাধীন সূত্র, নেই অভিযোগকারীদের বক্তব্য, নেই কোনো পাল্টা প্রশ্ন। আছে শুধু অভিযুক্ত কর্মকর্তার বয়ান—হুবহু। এটি কি সাংবাদিকতা? নাকি ক্ষমতাবানদের জন্য কলমভিত্তিক আইনি ঢাল? যখন একটি গণমাধ্যম একজন বিতর্কিত কর্মকর্তাকে ‘যুধিষ্ঠির’ বানাতে ব্যস্ত থাকে, তখন সেটি আর গণমাধ্যম থাকে না—তা হয়ে ওঠে সাফাই মঞ্চ।
হারুন অর রশিদের পক্ষে আরেকটি যুক্তি বারবার সামনে আনা হচ্ছে—“কোনো তদন্ত হয়নি, তাই অভিযোগ মিথ্যা।” অথচ বাস্তবতা হলো, তদন্ত না হওয়াই এখন অভিযোগের সবচেয়ে বড় প্রমাণ। সিন্ডিকেট শক্তিশালী হলে তদন্ত থেমে যায়, নথি তৈরি হতে সময় লাগে, আর ক্ষমতাবানদের বিরুদ্ধে প্রক্রিয়া শুরু করাই হয়ে ওঠে সবচেয়ে কঠিন কাজ। সুতরাং প্রশ্ন থেকেই যায়—তদন্ত না হওয়াই কি নির্দোষতার সার্টিফিকেট, নাকি তদন্ত আটকে রাখাটাই সিন্ডিকেটের সবচেয়ে বড় সাফল্য?
এই প্রতিবেদন কোনো রায় নয়। এটি প্রশ্নের তালিকা। ১০ কোটি টাকার হিসাব, একদিনে ছয়টি টেন্ডার, পরিবারকেন্দ্রিক কাজ বণ্টন, নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের অতীত এবং গৃহপালিত গণমাধ্যমের সক্রিয় সাফাই—সব মিলিয়ে প্রশ্ন একটাই। জুলাইয়ের রক্ত কি কেবল শাসক বদলের জন্য ছিল, নাকি ব্যবস্থার বদলের জন্যও? ব্যবস্থা যদি না বদলায়, তাহলে হারুনরা বদলাবে কেন?
এখন দায়িত্ব দুদক, প্রধান প্রকৌশলী, অন্তর্বর্তী সরকার এবং প্রকৃত সাংবাদিকদের। এই নিষিদ্ধ সিন্ডিকেটের বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলা হবে, নাকি গৃহপালিত কলম দিয়েই সব ঢেকে রাখা হবে—সেটাই এখন দেখার বিষয়।